প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা নতুন নতুন প্রকল্পের জন্য চাপ দিতেন। কারণ, নতুন প্রজেক্ট মানে বড় কমিশন। শেখ হাসিনা এ বিষয়ে সব জানতেন। কিন্তু তিনি তা কখনো করেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন, তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গ্রেফতারের পর থেকে তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। সালমান এফ রহমানের দাবি, শেখ পরিবারের অতিরিক্ত লোভের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এটা সবসময় সরকারের কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দ্বারা সমর্থিত ছিল। শেখ হাসিনাকে বোঝাতে গিয়ে অনেকেই নেমে পড়েছেন। কারণ, তিনি সব সময় নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতেন।

সালমান এফ রহমানের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এস আলমের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া দেড় লাখ কোটি টাকার অর্ধেক শেখ রেহানা ও সজিব ওয়াজেদ জয়কে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব অনিয়ম হয়েছিল। কিন্তু এসব নিয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পায়নি। শুধু মানি লন্ডারিং নয়, দেশের ইস্টার্ন রিফাইনারি, চিনিকল কেড়ে নিয়েও এস আলমের ব্যাপারে সবাই নীরব।

সূত্র আরো জানায়, সালমান রহমান লুটপাটের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে বেছে নেন। তাই নিজের পছন্দ অনুযায়ী চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগ দিতেন। পছন্দ না হলে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ব্যাংকে যোগদান করতে দিতেন না। কেউ যোগ দিলেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদত্যাগে বাধ্য করতেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব হেদায়েত উল্লাহ আল মামুনকে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও সালমানের পছন্দ না হওয়ায় তিনি যোগ দিতে পারেননি। একইভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করলেও দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চুপ থাকেন সালমান এফ রহমান। তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাকে বন্ড থেকে প্রায় 7000 কোটি টাকা তোলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তিনি বারবার অসুস্থতার কথা এড়িয়ে গেছেন। প্রশ্ন ছিল, কেন তিনি ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নামে একটি বন্ড ছেড়ে দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করলেন? বন্ডটি আসলে বেক্সিমকো গ্রুপের হাউজিং কোম্পানি শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের ছিল নাকি? কারণ, এই বন্ডের মাধ্যমে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এই প্রতিবেদককে বলেন, সালমান এফ রহমান ‘সুকুক’ বন্ডের মাধ্যমে ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন বলে তাদের কাছে তথ্য এসেছে। তিনি ব্যাংকগুলোকে এসব বন্ড কিনতে বাধ্য করেন। ব্যাংকগুলো প্রথমে বিনিয়োগে রাজি না হওয়ায় পরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হয়, যাতে ব্যাংকগুলো বন্ডে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু অসুস্থতার অজুহাতে বারবার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন সালমান।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে গত ১৩ আগস্ট রাজধানী ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে তার বান্ধবী অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমের জামিন, নিয়োগ, বদলি ও পদায়ন ব্যবসা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি প্রথমে তা অস্বীকার করলেও এখন বলছেন, এর বেশির ভাগই ছিল সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুরোধ। তবে মাঝে মাঝে তৌফিকা করিম নিজেও কিছু করে থাকতে পারে। তবে এর পরিমাণ খুবই কম বলে দাবি করেন তিনি। কোথায় ছিল ঘুষের লেনদেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল চুপ থাকেন।

জানা গেছে, রিমান্ডে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনিও জিজ্ঞাসাবাদে তার অসুস্থতার বিষয়টি তুলে ধরছেন। গোয়েন্দারা জানান, চাঁদপুর পৌরসভার মালিকানাধীন ১২ তলা ভবনের তৃতীয় তলায় ৩৩০০ বর্গফুটের একটি ফ্লোর কিনেছিলেন দীপু মনি। তবে চার তলা দখল করে তার ভাই ডা. ওবায়দুর রহমান টিপু। আবার চাঁদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি জমি দখল করে ৪০০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। পরে ওই এলাকার নাম হয় দীপুনগর। তবে তদন্ত কর্মকর্তাদের এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বাড্ডায় ফুজি টাওয়ারের সামনে সুমন সিকদারকে (৩১) গুলি করে হত্যার অভিযোগে গত ১৯ আগস্ট সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনিকে বারিধারা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিমান্ডে থাকা সবাই সবকিছুতে শেখ হাসিনার কথা বলছেন। তবে এখনও গ্রেপ্তার হয়নি এমন কয়েকজনের নাম তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এসব তথ্য তদন্ত করে দেখা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকেরও একই অবস্থা। জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই কান্নাকাটি শুরু করেন তিনি। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ, এটুআই প্রজেক্ট, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাই-টেক পার্ক, আইটি পার্ক তৈরির নামে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতির বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। তিনিও গতকাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও তার ছেলের কাঁধে সবকিছু চাপানোর চেষ্টা করছিলেন। রিমান্ডে থাকা রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম সোহেলের কাছ থেকে খুব বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বের করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

গত ১৫ আগস্ট সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর আগে গত ১৪ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় এই তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে রাজধানীর পল্টনে এক রিকশাচালককে হত্যার অভিযোগে পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে ১৫ আগস্ট রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে হকার হত্যার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

20 আগস্ট, পুলিশ ঢাকার বনানী থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য বরখাস্ত হওয়া চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল এবং সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেনকে রামপুরা থেকে গ্রেপ্তার করে। পল্টন থানায় দায়ের করা যুবদল নেতা নবীন তালুকদার হত্যা মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গত ২১ আগস্ট তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে গত ২২ আগস্ট গুলশানে তার বাসা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ আগস্ট আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে গতকাল তাকে আদালতে পাঠান তদন্তকারী কর্মকর্তা।

গত ২৪ আগস্ট সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী ও গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজীকে রাজধানীর শান্তিনগরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় শেখ হাসিনা, গোলাম দস্তগীর গাজী ও গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। 105 জন। ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপকে গত রোববার রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গার্মেন্টস কর্মী রুবেল হত্যা মামলায় তাকে আদাবর থানায় গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে গত ২৬ আগস্ট নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *