সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশে সড়ক ও যোগাযোগ খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে অনেক প্রকল্প সময়সীমার পরও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সারাদেশে সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে শত শত অপ্রয়োজনীয় ও কম প্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এবং দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কাটা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এই উপদেষ্টা বাস্তবায়নাধীন এমনকি কম-প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলি বন্ধ করার পক্ষে তার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এদিকে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সফররত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলকে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান বলেন, বিগত সরকার (আওয়ামী লীগ) তাদের প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনীয় শত শত প্রকল্প নিয়েছে। তারা অনেক ব্যয়বহুল প্রকল্প নিয়েছে, তারা আর্থিকভাবে সফল নয়। জানা গেছে, পরিবর্তিত বাস্তবতায় কম গুরুত্বপূর্ণ ও অতিরিক্ত মূল্যের এসব প্রকল্প বাতিল ও স্থগিত করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। যেসব প্রকল্পে অগ্রগতি খুবই কম, সেগুলো বাতিল বা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোচিত ১৫টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যয় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই ১৫টি প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ৭৭ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত মূল্যায়নের কারণে সেখানে ব্যয় বেড়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে প্রায় প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধিসহ লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। ফলে ধীরে ধীরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়ছে খরচও। এমন ১৫টি প্রকল্পে ৬০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা খরচ হতে চলেছে, যা মূল খরচের প্রায় দ্বিগুণ। অনুমোদনের সময় এই ১৫টি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭ হাজার ৮৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।

সড়ক পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে প্রকল্পটি সঠিকভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হলে বাড়তি অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা নয়। এটা জাতির জন্য একটি বড় অপচয়। সেই সাথে দেশ ও জাতি যে সুফল পাওয়া উচিত তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগায় জনদুর্ভোগ যুক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত, বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিআরটি গাজীপুর-বিমানবন্দর (বৃহত্তর ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট) প্রকল্প। চার বছর মেয়াদী এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে এখন 12 বছর সময় লাগছে, যা ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ 2024 সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এর মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২০৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ফলে এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ২২২৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা যাচ্ছে। অদূরদর্শী এ প্রকল্পের কারণে গাজীপুর-বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশ সরু হয়ে পড়েছে। ফলে সড়কের বিভিন্ন স্থানে যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রকল্প শুরুর আগেই এর সুফল নিয়ে শুরু হয়েছে নানা সমালোচনা।

অত্যধিক প্রাক্কলিত প্রকল্প যেখানে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পে সহায়তা, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু-গুন্দুম পর্যন্ত রেল ট্র্যাক নির্মাণ, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। ), খুলনা- মংলা রেলওয়ে নির্মাণ, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণ, খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প ইত্যাদি। সূত্র জানায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনা ছিল। জুলাই 2007 থেকে জুন 2015 এর মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। তখন প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল 10 হাজার 161 কোটি 75 লাখ টাকা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়াসহ নানা জটিলতায় শুরুতেই হোঁচট খায় প্রকল্পটি। পরবর্তীতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। সর্বশেষ মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মূল বরাদ্দের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৪৪৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, যা তিন গুণের বেশি। 2011 সালে, সরকার ‘চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড’ প্রকল্প হাতে নেয়। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও কাজ শেষ হয়নি। চতুর্থ ধাপে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা থেকে দাঁড়ায় ২৬৭৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে বাড়তি ব্যয় হয়েছে ১৮১৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এটিও মূল খরচের তিনগুণ বেশি। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ছাড়াও বর্তমানে চালু থাকা মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পটি চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) গুরুত্ব পেয়েছে মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত 20 হাজার 757 কোটি টাকা খরচ হয়েছে। দেশের প্রথম পাতাল রেল মেট্রোরেল লাইন-১ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, যার বরাদ্দ রয়েছে ১ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। মেট্রোরেল লাইন-5 উত্তর রুট প্রকল্পের জন্য 968 কোটি টাকা বরাদ্দ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর জন্য বরাদ্দ ২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এসব প্রকল্পে জাপানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।

তা বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে চীন। দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর বাস্তবায়নে চীন এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে সহায়তা, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং সাসেক লিংক রোড প্রকল্প: এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ। দেশব্যাপী চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয়ের ওপর এরই মধ্যে লাগাম টানতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ১৩টি প্রস্তাব ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সংসদ ভেঙে দেওয়ায় সংসদ সদস্যদের জন্য বরাদ্দের প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যেই সাশ্রয় হয়েছে। মেগা অবকাঠামোর বিকল্প অর্থায়নের কথাও ভাবা হচ্ছে। অর্থ বাঁচাতে যৌক্তিক কারণে উন্নয়ন বাজেট কাটতে চলেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কালুরঘাটে রেল ও সড়ক সেতু, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের সড়ক উন্নয়ন এবং ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ককে চার লেন করতে জমি অধিগ্রহণ। রেমিটেন্সের পাশাপাশি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, চট্টগ্রাম-দোহাজারী ডুয়েলগেজ রেলওয়ে এবং মেট্রোরেল লাইন ওয়ান ও ফাইভ প্রকল্পের ব্যয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকল্প ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সাবেক সংসদ সদস্যরা তাদের নির্বাচনী এলাকার জন্য অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো এখনো চলছে। অনেকেই যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের অগ্রাধিকার আছে কি না এবং কতটা সুবিধা বয়ে আনবে তা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কম অগ্রাধিকার প্রকল্প কাটা হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশে সড়ক উন্নয়নে ব্যয় অনেক বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চার লেনের সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ১২-১৫ কোটি টাকা খরচ হবে। প্রতিবেশী ভারতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয় ১০ কোটি টাকা। চীনে 10-12 কোটি টাকা। ইউরোপে 30 কোটি। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের তুলনায় বাংলাদেশ বেশি অর্থ ব্যয় করে। বিশ্বব্যাংক খরচ বাড়ার জন্য উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি, দেরিতে কাজ শেষ হওয়া এবং দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাবকে দায়ী করেছে। ২০১৬ সালে শেষ হওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নির্মাণ ব্যয় প্রতি কিলোমিটার ছিল ২১ কোটি টাকা। হাটিকুমরুল থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর সড়ক চার লেন থেকে আট লেনে করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ২২ কোটি টাকা। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যয়ে ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দুই লেনের এই মহাসড়ককে চার লেনে রূপান্তর করতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক হলো ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, যার নির্মাণ ব্যয় প্রতি কিলোমিটার 200 মিলিয়ন 80 মিলিয়ন টাকা।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, “ঋণদাতা দেশগুলোর বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণে ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। কয়েকটি কারণে এটি হয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য অভাব রয়েছে। যারা প্রকল্পের মূল্যায়ন করেন তাদের মধ্যে ক্ষমতা এবং এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র না হলে, দরপত্রের মূল্য হিসাবে জমা করা হয় আনুমানিক মূল্য তার চেয়ে কম হয় না এবং আমাদের রাস্তার প্রকল্পে প্রচুর ব্যয় করা হয়।

Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *