৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৮০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের তদন্ত করছে দুদক। ওই তদন্তে এ পর্যন্ত ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব বা আবাসিক কার্ড থাকার তথ্য পেয়েছে দুদক।
এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গোপনে সাইপ্রিয়টের নাগরিকত্ব নেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের কাছে বেলজিয়ামের ‘রেসিডেন্স কার্ড’ রয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের নাগরিক। সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনায়েদ আহমেদ পলকের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধ অনুমতি বা ‘সবুজ কার্ড’ রয়েছে।
দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের পাঁচ সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নাগরিকত্ব রয়েছে। তারা হলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল, মোঃ তাজুল ইসলাম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মোঃ মাহবুব আলী। তাদের মধ্যে মাহবুব আলীকে ১৫ সেপ্টেম্বর গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হয়।
চার সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীসহ সাতজন সংসদ সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা গ্রিন কার্ড রয়েছে। দুদকের তদন্তে এ পর্যন্ত যাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলেন- আবদুস শহীদ, নসরুল হামিদ, জুনায়েদ আহমেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আবদুস সোবহান মিয়া (রোজ), মাহফুজুর রহমান ও সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ। এদের মধ্যে সাবেক কৃষিমন্ত্রী আবদুস শহীদ, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে কানাডার নাগরিকত্বধারী ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। এদের একজন সাবেক মন্ত্রী, বাকিরা সাবেক সংসদ সদস্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (নাসিম), শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম (শিমুল) ও হাবিব হাসান।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সুইস নাগরিকত্ব এবং সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের জাপানে বসবাসের কার্ড রয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য (টাঙ্গাইল-২ আসন) তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির নাগরিক এবং সাবেক সংসদ সদস্য (ময়মনসিংহ-১১) এমএ ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের তদন্তে নামে ২৪ জনের মধ্যে পাঁচজন এখন কারাগারে। বাকিরা ৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে আসেনি। তাদের মোবাইল নম্বরও ব্লক করা হয়েছে। অনেকেই দেশ ছেড়েছেন বলে গুজব রয়েছে। এ কারণে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে ব্যক্তি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারবেন না।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এমনটি করা হয়ে থাকে তাহলে তা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী হয়েছে।
দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, যারা বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে দেশে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন তারা আসলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
তিনি বলেন, মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের শপথ নেওয়া অবৈধ। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে মন্ত্রী-এমপি হওয়া আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ দেশে রাজনৈতিক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনাচার যেভাবে গড়ে উঠেছে, তা স্বাভাবিক হয়েছে। তথ্য গোপন ও প্রতারণাকারী প্রভাবশালীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন প্রয়োজন।